আমার মেয়ে তখন কেবল কথা বলা শিখেছে। প্রতিদিন রাতে ঘুমোনোর সময় আমি তাকে একটাই গল্প শোনাতাম—ইবরাহিম আলাইহিস সালামের।
প্রতিদিন একই প্যাটার্নে, একই শব্দচয়নে গল্পটা বলতাম। গল্পের প্যাটার্নটা ছিল এরকম—
‘এক দেশে এক বালক ছিল। বালকের নাম ছিল ইবরাহিম। একবার রাতের আকাশে চাঁদ মামা দেখে ইবরাহিম খুব অবাক হলো। ইবরাহিম বললো, ‘বা! বা! বা! কী সুন্দর চাঁদ! কী সুন্দর এর আলো! এটাই আমাদের রব মনে হয়’।
তারপর আরো কিছু সময় পার হলো। এক সময় সেই চাঁদকে আর আকাশে দেখা গেল না। এতে ইবরাহিমের খুব মন খারাপ হলো। ইবরাহিম বললো, ‘যেটা ডুবে যায়, যেটা অস্ত যায় সেটা আমাদের রব হতেই পারে না’।
প্রতিদিন একই গল্প, একই প্যাটার্ন আর শব্দচয়নে শুনতে শুনতে সেটা আমার মেয়ের মুখস্ত হয়ে যায়। মা শা আল্লাহ। কিন্তু, সে যে মুখস্ত করে ফেলেছে গল্পটা সেটা আমি জানতাম না। একদিন গল্পটা বলতে গিয়ে আনমনে গল্পের প্যাটার্ন থেকে একটু বিচ্যুত হতেই মেয়ে আমাকে শুধরে দিয়ে বললো, ‘হয়নি হয়নি’।
আমি বললাম, ‘কী হয়নি?’
-‘গল্প তো এরকম। ‘বা! বা! বা! কী সুন্দর চাঁদ! কী সুন্দর আলো! এটাই আমাদের রব মনে হয়’।
আমি চমকিত হলাম। শুনতে শুনতে গল্পটা যে তার হুবহু মনে গেঁথে যাবে, সেটা আমি কল্পনাও করিনি। আল্লাহুম্মা বারিক লাহা।
যেকোনো কিছু আত্মস্থ করা ছোটদের জন্য যতোখানি সহজ, বড়দের জন্য ততোখানিই কঠিন। ছোটদের মস্তিষ্কের নিউরো সেল যতোদ্রুত কানেকশান তৈরি করতে পারে, বড়দের মস্তিষ্ক সেটা পারে না। ফলে, নতুন জিনিস শেখা আর ধারণ করার বিষয়ে ছোটদের মস্তিষ্ক বড়দের চেয়ে অনেকগুণে এগিয়ে। তাই, সন্তানকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলতে হলে ছোটবেলাতেই তার সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করা চাই।
নবি রাসূলদের জীবনের দিকে তাকালে আমরা জিনিসটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবো।
নবি মুসা আলাইহিস সালামের ছোটবেলা কেটেছে আছিয়া আলাইহাস সালামের মতো বিদূষী, আল্লাহর অতি প্রিয় এক বান্দীর যত্ন, ভালোবাসা আর পরিচর্যায়। ঈসা আলাইহিস সালাম বড় হয়েছেন বায়তুল মুকাদ্দাসের ভেতরে—মাতা মারইয়াম আলাইহাস সালাম এবং নবি যাকারিয়া আলাইহিস সালামের তত্ত্বাবধানে। আমাদের রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জন্মের পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পাঠিয়ে দিয়েছেন হালিমা নামের এক বেদুইন নারীর ঘরে যেখানে মজুদ ছিল তাঁর চিন্তা, কৌতূহল আর ভাবনার ডালপালা মেলার উপযুক্ত পরিবেশ।
সুতরাং, সন্তানের ছোটবেলা কোনোভাবেই হেলাফেলা করে পার করে দেওয়ার অবকাশ নেই।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জেনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল। আর তোমরা নিজ অধীনস্তদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে’।
আমাদের সন্তান যদি আমাদেরই অবহেলার কারণে বিপথগামী হয়, যদি আমরা তাদের সঠিক পরিচর্যা না করি—তাদের ঈমানের, আমলের, তাকওয়ার, যদি আমাদেরই গাফিলতিতে তারা আল্লাহকে ভালোভাবে চিনতে না পারে, এই সমস্তটার জন্যে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, যেভাবে সন্ধ্যেবেলা রাখালকে জবাবদিহি করতে হয় তার মেষের পাল সম্পর্কে।
সন্তানের সঠিক পরিচর্যা মানে তার যথেচ্ছ আবদার পূরণ নয়। তার যাবতীয় আস্কারাকে প্রশ্রয় দেওয়াও নয়। তার সঠিক পরিচর্যার অনেকখানি জুড়ে আছে তাকে তার শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
যে সহজাত বিশ্বাসের প্রবৃত্তি নিয়ে সে জন্মায়, সেই বিশ্বাসের পথে তাকে দৃঢ়চিত্তে চলতে শেখাবার নামই হলো পরিচর্যা। যে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত ইলাহকে, সেই সুমহান রবের সাথে বুনিয়াদি সম্পর্ক বিনির্মাণের পথে সন্তানকে অগ্রসর করে দেওয়ার নামই—তারবিয়াহ।
তারা যেন তাদের রবকে চিনতে পারে, ভালোবাসতে পারে এবং ভয় করতে পারে—এই উদ্দেশ্য থেকেই আমি আমার সন্তানদের পরিচর্যা করি। কুরআন থেকে, হাদিস থেকে, ইসলামের ইতিহাস আর ঐতিহ্য থেকে আমি তাদের গল্প শোনাই। তারা শুনে। শুনতে শুনতে ঘুমোয়।
আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন, আজ থেকে বেশ অনেক বছর পর, এমনই নিশীথে তারাও বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প শোনাবে তাদের অনাগত উত্তরসূরীদের। হয়তো—আমি তখন অনন্ত আখিরাতের বাসিন্দা হয়ে যাব। কিন্তু আমার রোপন করে আসা ছোট্ট চারা-বীজ যে মহিরুহ হয়ে আকাশে মেলে দেবে অসংখ্য ডালপালা, সেই ছায়া কি আখিরাতে আমার নাযাতের উসিলা হয়ে যাবে না? আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন—অবশ্যই তা হবে।
আমার সন্তানদের আমি যেভাবে শেকড়ের গল্প বলি, ঠিক সেই একই গল্পগুলো আমি শোনাতে চাই আরো অনেক অনেক ছোট্ট সোনামণিদের। গল্পের মাধ্যমে একটা আস্ত প্রজন্মকে শেকড় চেনাবার অদম্য বাসনা থেকে আমি তাদের জন্য গল্প লিখতে শুরু করেছি। আমার সেই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার প্রথম সংকলনের নাম ‘পবিত্র মাসজিদের গল্প’ যা ইতোমধ্যে প্রকাশের দ্বারপ্রান্তে আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
‘পবিত্র মাসজিদের গল্প’ সিরিজে আমি ছোট্ট সোনামণিদের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের তিনটি পবিত্রতম মাসজিদের সাথে যেগুলো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের সাথে। ছোটদের জন্য করা আমার এই প্রথম কাজ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার যাবতীয় তথ্য প্রথম কমেন্টে দেওয়া থাকলো। ওয়ামা তাওফিক্বী ইল্লাবিল্লাহ।
0 Comments